জীবন, বাড়ি আছো ?

আট ফুট বাই আট ফুট ঘরের ছোট্ট জানালাটা,
যেটা খুললেই দেড় ফুটের একটা তেকোনা আকাশ দেখা যেত
একটা তার দিয়ে আড়াআড়ি দুভাগে ভাগ করা,
ওটার সামনেই তেপায়া টুলটার উপর বসে,
রেডিওটা গাইছিল, ‘চাঁদ কেন আসে না আমার ঘরে’।
তালে তালে হাওয়ায় দুলছিল
উপরের দড়ি থেকে ঝোলা লুঙ্গি আর গামছা।
বাথরুমের টিনের বালতিতে জল পড়ার শব্দে জীবন কাব্যময় হয়ে ওঠে হঠাৎ মাঝে মাঝে।
যদিও সেরকম হওয়ার কথা নয়, কারণ হিসাব বলছে,” ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়”। তবুও মাঝে মাঝে হিসাব মেলে না; কারণ, জীবন এরকমই। জীবন এরকমভাবেই সমস্ত হিসাব উল্টেপাল্টে দিয়ে জীবিত থাকার প্রমাণ দিয়ে যায়।
তবু, যতই জীবন মাতব্বরি করুক,
রাজ্যটা ক্ষুধারই।
ঘরের মেঝেতে একচিলতে খালি জায়গাটায় দাঁড়িয়ে বোন চুল আঁচড়াচ্ছে; এরপর খাটের তলায় মা আর নিজের বিছানাটা পেতে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকবে। ভাই চৌকাঠে বসে বিড়ি ধরিয়ে স্নান করতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে আর ভাবছে, কালকের জীবনটা আজকের থেকে কতটা আলাদা হওয়া সম্ভব। মা রান্নাঘরে যতটা সম্ভব কম সবজি নিয়ে চারজনের তরকারির জোগাড় করছেন। বাবা জানালার পাশে বসে বিড়বিড় করে ভুল বকছেন; এই সময়টায় ওনার রোজ কমরেড লেনিনকে মনে পড়ে।
যে যাই করুক, যেখানেই থাকুক, যাই বলুক,
সকলেই কিন্তু অপেক্ষা করছে সেই মুহূর্তটার,
যখন মা বোনকে ডেকে বলবে খাটের একদিকে প্লাস্টিক পেতে,
বাবা আর ভাইয়ের থালাদুটো নিয়ে যেতে
আর, গরম রুটির গন্ধে ভরে যাবে ঘর।
জীবন তো থাকবেই, রুপকথাও,
যেখানে সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে কোন এক দুর্গম পাহাড়ের গুহায়
সোনার কৌটোয় রাখা থাকবে দুটুকরো রুটি।
কিংবা সেই স্বপ্নের দেশ,
যেখানে আকাশে বসে কারা ভাত রাঁধে,
আর গরম ভাতের সুগন্ধে ভরে পৃথিবী।
ক্ষুধাও থাকবে, থাকবেই;
ক্ষুধা কি জীবনের অন্যতম প্রমাণ নয়?
সে জন্যই, হয়ত, মাঝে মাঝে,
জীবনের কাব্যিক ছন্দ ভেঙে দিয়ে লেখা হবে ক্ষুধার কাহিনী।
তবুও, আপাতত বাথরুমের বালতি ভরে যায়, ভাই উঠে যায় কারখানার সমস্ত ক্লেদ, আর মালিকের সংস্পর্শ গা থেকে ধুয়ে ফেলতে।
বোন বাবাকে ধমকে চুপ করিয়ে চলে যায় রান্নাঘরে, চিরুনিটা দেওয়ালে ঝোলানো প্লাস্টিকের ব্যাগগুলোর মধ্যে কোন একটাতে রেখে। তবুও, বাবা চুপ করেন না। চুপ করবেন কি করে, উনি তো দেখতে পাচ্ছেন জানালা দিয়ে, সামনের ল্যাম্পপোস্টের নিচে, কালো ওভারকোট পরে অধৈর্য হয়ে পায়চারি করছেন কমরেড লেনিন। উনি কি জানেন না, ওভারকোটের পকেটে যে কাগজের গোছাটা রয়েছে, সেটা কত মুল্যবান? বয়লার ফেটে যারা যারা বসে গিয়েছিল, তাদের হাতে হাতে কাগজগুলো পৌঁছে দিতে না পারলে, মালিকপক্ষের সঙ্গে লড়াইটা যে শেষই হয়ে যাবে, ক্ষতিপূরণ আর পাওয়া যাবে না। কিন্তু এরা যে কিছুতে বুঝতেই চায় না।
এরই মধ্যে ব্রাহ্মমুহূর্তের সমাগম হয়,
প্লাস্টিক পড়ে বিছানার একপাশে।
কিন্তু হঠাৎ সুর কেটে যায়,
থালায় তরকারির পরিমাণ দেখে চিৎকার করে গালাগালি দিয়ে ওঠে ভাই,
বোন ওড়নার একটা কোণ কামড়ে ধরে চোখ বুজে ফেলে,
মা এসে তাঁর ভাগের ছিটেফোঁটাটুকু দিয়ে চলে যান।
ঘাড় গুঁজে খাওয়া শেষ করে ভাই, সবাই।
হাত ধুয়ে শেষ বিড়িটা বের করে নিলে প্যাকেটটা নিতান্ত মূল্যহীন হয়ে পড়ে। বিড়িতে জোরে জোরে টান দিতে দিতে ভাই শুনতে পায় বোনের ফোঁপানি। দাঁতের ফাঁক দিয়ে ধোঁয়াটা উড়িয়ে দিয়ে কালো আকাশের গায়ে সমস্ত কিছুর একটা কারণ খোঁজার চেষ্টা করে। দশ ঘণ্টারও উপর লোডিং ডিপার্টমেন্টে কাজ, না খেলে শরীর টিকবে? তার হাত যদি বন্ধ হয়ে যায়, চারজনের খাবারও যে বন্ধ হয়ে যাবে। তবু কোথাও একটা খটকা থেকেই যায়, দশ ঘণ্টার লেবার, এত টাকা যায় কোথায়?
পুরোনো বিড়ির প্যাকেটটা ফেলে দিলেও, কোন চিন্তা করতে হয় না। কারখানা থেকে ফেরার পথেই আজ একটা নতুন প্যাকেট নিয়ে এসেছে; রাতে বিড়ি ফুরিয়ে গেলে কি হয়, তা জানে ভাই। ঘরে গিয়ে টেবিলের উপর রাখা নতুন বিড়ির প্যাকেটটায় হাত বুলিয়ে নেয় একবার পরম মমতায়। আর, তখনই চোখে পড়ে, খালি ওষুধের পাতাটা। শ্বাসকষ্টের ওষুধ মার, একদিনও বাদ গেলে যায় যায় অবস্থা হয়। আজ বেরোনোর সময়ই বলে দিয়েছিল মা, ওষুধ শেষ।
অদ্ভুত একটা অসহায় বোধ হয়,
এত রাতে কান্না পেলে কি করতে হয়, তা তো জানে না সে।
একটা জ্বালা জ্বালা ভাব দানা বাঁধে চোখের কোণে, গলায়।
দমচাপা একটা কষ্ট ঠেলে ওঠে বুক, গলা বেয়ে,
সারা শরীর জুড়ে বেরিয়ে আসে, সারা ঘরে,
ছুটে বেরোয় রাস্তায়।
ঘুমন্ত পাড়া, বাসস্ট্যান্ডের ঘুমন্ত বাসের পাশ দিয়ে
ছুটতে থাকে, আর সবাই ঘুমোয়,
কেউ দরজায় কড়া নাড়ে না, অনুভুতি ঘুমোয়।
ছুটতে ছুটতে হাঁপিয়ে পড়ে, অনেক দূরে
অনেক দূরে, এক আধো-অন্ধকার রাস্তায়।
যেখানে জীবন এক রহস্যময় সাইকেল আরোহীর মত
আস্তে আস্তে ল্যাম্পপোস্টের আলোর আওতা থেকে বেরিয়ে
মিলিয়ে যায় গভীর রাতে।
ক্ষুধার্ত কুকুর আর তার নাগাল পায় না তাড়া করে।
ঠিক তখনই নিস্তব্ধ শান্তি নামে, দূর পাহাড়ের কোলে নাম না জানা গ্রামে।
আর এখানে,
রাতের নিস্তব্ধতা খানখান করে কেঁদে ওঠে কোন হবু ভোটার,
যেন জানতে চায়, এ পৃথিবী তার বাসযোগ্য হয়েছে কিনা।

2 thoughts on “জীবন, বাড়ি আছো ?

Leave a comment