ছোট্ট একটা ‘মে দিবস’

একটা ছোট্ট ফ্ল্যাটবাড়ির ছোট্ট একটা দু-কামরার ফ্ল্যাটে থাকে আমাদের ছোট্ট বন্ধু টিনটিন, পাপা আর মার সঙ্গে। তার একটা বিশাল কাবার্ড আছে।তার মধ্যে আছে অনেকগুলো রঙিন ড্রেস, একটা ব্যাট, একটা ফুটবল আর অনেকগুলো বুক। টিনটিন এখন ক্লাস ফাইভ, কিন্তু ওর দশটা সাবজেক্ট, তার জন্য বারোটা বুক, যে সাবজেক্টটা সবচেয়ে বাজে, সেই অঙ্কের জন্য দুটো বুক। কিছু কিছু ভালো বুকও আছে, যেমন অনেকগুলো কালারফুল ড্রইং বুক, টিনটিন কমিক্স এর পুরো সেট। পাপা বলেছে, নেক্সট ক্লাসে উঠতে ভালো রেজাল্ট হলে, হ্যারি পটারের পুরো সেট কিনে দেবে। তাছাড়া একটা স্ট্রেঞ্জ বুক আছে, কার একটা গ্র্যানির লেখা, তবে বাংলায়। টিনটিন ওটা নিজে নিজে পড়তে পারে না, মা আগে দু একটা স্টোরি পড়ে শুনিয়েছিল, বেশ ইন্টারেস্টিং, তবে বেশিরভাগই অ্যাবসার্ড। তবে এখন টিনটিন সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত যেটা নিয়ে, সেটা হল ছোট্ট একটা ডগি হাউস বানানো। অ্যাপার্টমেন্টে ওর কোন ফ্রেন্ড নেই বলে, মা আর পাপা মিলে ঠিক করেছে ওকে একটা ছোট্ট ডগির বাচ্চা এনে দেবে। টিনটিন এখন সেটা নিয়ে খুব এক্সাইটেড। আজকেই তো সবাই মিলে যাওয়া হবে কিনতে, টিনটিন তাই শেষ মুহূর্তের গোছগাছ করতে ব্যস্ত।
ওঘর থেকে একটু গোলমালের শব্দ পেয়ে তাড়াতাড়ি কাজ ফেলে উঠে গেল টিনটিন। মা আর পাপা এত বড় হয়ে গিয়েও সারাক্ষণ ছোট ছোট ব্যাপার নিয়ে ঝামেলা করে কি বলবো। টিনটিন না থাকলে কে যে মেটাত এইসব, ও ভেবেই পায় না।
– দেখো, আমি শখ করে যাচ্ছি না, আর্জেন্ট কল এসেছে, নিশ্চয়ই কিছু প্রবলেম ক্রিয়েট হয়েছে।
– প্রবলেম সলভ করার জন্য ম্যানেজার আছে, অন্য এমপ্লয়িরা আছে, তোমাকেই যেতে হবে?
– একটা অর্গানাইজেশনে সকলের দায়িত্ব সমান।
– হ্যাঁ, শুধু ক্ষমতা আর সামর্থ্য আলাদা আলাদা, স্যালারি আলাদা, খাটনি এক।
– যতদিন না সকলে ইউনাইটেড হতে পারছি ততদিন এক্সপ্লয়েটেশন আটকানো যাবে না, কিছু করার নেই।
– ওসব কীর্তন রাখো। ইউনাইটেড! সকলের মুরোদ জানা আছে। ভেড়ার পাল ইউনাইটেড হবে রাখালের বিরুদ্ধে, আহা!
ওফ! আবার সেই, পাপার অফিস থেকে ফোন এসেছে, ছুটি ক্যান্সেল। সেই ছোট থেকে দেখে আসছে, সারাদিন কাজ, কাজ আর কাজ,একটুও ছুটি নেই। ছুটির দিনেও কাজ আর অফিস। মা ঠিকই বলে, পাপাটা একদম জু এর বাঘটার মত হয়ে গেছে, সারাক্ষণ খাঁচায় আটকা। ধুস! এইদিনগুলো সবচেয়ে খারাপ, এখন আর ডগি আনতে যাওয়া হবে না, সারাদিন মাও রেগে রেগে থাকবে, আর বই নিয়ে বসে থাকবে, টিনটিন কি করবে, ওর তো ফ্রেন্ড কেউ নেই এখানে। আজকে তো স্কুলও নেই। সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়ল ও। শুয়ে শুয়ে ভাবছে কি করা যায়, কি করা যায়, এমন সময় মনে হল কাবার্ডের মধ্যে কারা যেন কথা বলছে। হাউ ফানি, কাবার্ডের মধ্যে লোক আসবে কি করে!
উঠে গিয়ে কাবার্ড খুলে টিনটিন তো অবাক, সব বুকগুলো, ফুটবলটা আর জামাকাপড় গুলো নিজেদের মধ্যে কথা বলছে! টিনটিনকে দেখে ওয়ান মোমেন্টের জন্য সবাই চুপ করে গেল, তারপর সবাই মিলে ওয়েলকাম করল টিনটিনকে।
– হ্যালো টিনটিন, গুড মর্নিং!
– “সেম টু ইয়ু!” তখনও বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি টিনটিনের।
– আগের বছর পুজোয় রিমি আন্টি যে ইয়েলো ড্রেসটা দিয়েছিল, সেটা বলল, “কি মাস্টার টিনটিন, মনখারাপ?”
– ফুটবলটা বলে “নাকি পাপার উপর রাগ হচ্ছে?”
টিনটিন অবাক, এরা সব জানল কি করে? হঠাৎ একটা ভারি গলা বলে উঠল, “পাপার উপর রাগ কোর না টিনটিন, বিশ্বাস কর, পাপার মন তোমার থেকেও খারাপ।” টিনটিন তাকিয়ে দেখে কাবার্ডটা হাসছে তার দিকে তাকিয়ে।
– শুধু তোমার পাপা কেন টিনটিন, সকলেরই মন খুব খারাপ, সকলেরই খুব কষ্ট টিনটিন…
– কেন?
– সকলকেই অনেক কাজ করতে হচ্ছে, কিন্তু কোন ছুটি নেই। খালি কাজ, কাজ, কাজ, ছুটি নেই, খেলা নেই, আনন্দও নেই।
– কারও ছুটি নেই?
– “না গো, ছুটি নেই। কেউ কেউ ছুটি পেলেও নিজেরাই ছুটি করতে পারে না, তাহলে খেতে পাবে না।” বুকগুলো, ফুটবল, ব্যাট, ড্রেস সবাই মিলে একসঙ্গে বলে উঠল।
– সত্যি?
– হ্যাঁ সত্যি, চলো না টিনটিন আমরা বরং একটু ঘুরে দেখেই আসি সবাইকে, এমনি দিনে তো বেরনোও হয় না, তোমাকেও পাবো না।
– “তোমরা সত্যি চলতে পারো?” টিনটিনের গলায় অবিশ্বাস।
– “চলো দেখাই যাক না। তুমি বরং ভেতরে চলে এসো।” জামাকাপড়গুলো একটু সরে গিয়ে জায়গা করে দিল ওকে।
– আমরা কোথায় যাব?
– “প্রথমে যাব আমার বাড়ি, মানে আমি যেখান থেকে এসেছি।” কাবার্ড বলল,” তারপর এ্রক এক করে “ফুটবলের বাড়ি, তারপর ইয়েলো ড্রেসের বাড়ি, তারপর ওই যে বইগুলো আছে, ওদের বাড়ি।”
টিনটিন ভেতরে গিয়ে বসল।
-চোখ বন্ধ কর।
টিনটিন চোখ বন্ধ করল। কয়েক সেকেন্ড পড়ে কাবার্ডই আবার বলল, “এবার চোখ খোলো টিনটিন, দেখো আমরা এসে গেছি, এখানে আমরা সবাইকে দেখতে পাচ্ছি, আমাদের কিন্তু কেউ দেখতে পাচ্ছে না।”
টিনটিন সামনে দেখল বিশাল একটা খোলা জায়গা সিমেন্ট বাঁধানো, কয়েকটা টিনের ছাউনি। অনেক লোক কাজ করছে, কেউ কাঠ চেরাই করছে, কেউ কাটছে, কেউ পালিশ করছে; সবাই ঘেমেনেয়ে একসা, তবু সবাই ঘাড় গুঁজে কাজ করে যাচ্ছে।
কাবার্ড বলল, “এরা সকালে যখন তুমি স্কুলে যাও, তখন থেকে কাজ শুরু করে, কাজ করে সন্ধ্যা হওয়ার পরেও অনেকক্ষণ। কোনদিন ছুটি নেই, সত্যি সত্যি জ্বর হলেও না। শুধু কাজ কাজ আর কাজ।”
– এত কাজ করে কেন?
– না হলে খাবে কি করে? দেখছ না তোমার পাপাকে কত কষ্ট করতে হয়, তবে তো তোমার স্কুল যাওয়া হয়, তোমাদের খাওয়াদাওয়া হয়, জামাকাপড়, সব হয়।
– আচ্ছা ওই যে দাদাদুটো কাজ করছে, ওরা হোমওয়ার্ক করবে কখন?
– ওদের হোমওয়ার্ক করতে হয় না ভাই, ওরা তো স্কুলেই যায় না।
– এহে, স্কুলেই যায় না? কেন?
– ওই যে দাদাটা দেখছ লাল টুপি পড়ে কাজ করছে, ওর নাম জহিরুল, খুব অল্পবয়সে ওর পাপা মারা গিয়েছিলেন অ্যাকসিডেন্টে, ওর মা চোখে দেখতে পান না। তাই ওই দাদাটা এখানে কাজ করে, নাহলে দাদাকে আর ওর মাকে কে খেতে দেবে?
– আরেকজন?
– ওই দাদাটার পাপাও এখানেই কাজ করত, ওই যে ঘরটা দেখছ, ওই যে বিশাল চাকার মত মেশিনটা, ওখানে। একদিন কাজ করতে করতে মেশিনের মধ্যে হাত চলে যায়, আর সঙ্গে সঙ্গে হাতটা ভেঙে, কেটে মেশিনে ঢুকে যায়।
– এ, মা! তারপর কি হল?
– তখন আঙ্কেলকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হল, আরও অনেক জায়গায় চোট লেগেছিল, সেগুলোর চিকিৎসা হল। কিন্তু আঙ্কেলের হাতটা বাদ চলে গেল, আর কাজ করতে পারল না।
– ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় নি?
– হ্যাঁ, চিকিৎসা খরচ আর সামান্য কিছু টাকা দেওয়া হয়েছিল, দু মাসের মাইনের মত। তাতে তো কিছু হয় না, তাছাড়া আঙ্কেল তো আর কোনদিনই কাজ করতে পারবেন না। তখন এই কারখানাটার মালিক, ওই দাদাটাকে কাজ দেয়, হাফ মাইনেতে। আর আঙ্কেল বাড়িতে বসে ঝুড়ি বানানোর কাজ করেন, তবে এদের সংসার চলে।
– আর, আঙ্কেল পেনশন পাবেন না?
– না। এরকম ছোটখাটো অনেক কারখানায় যারা কাজ করেন, তাঁরা প্রায় কোন সুবিধাই পান না, যতক্ষণ কাজ করেন, ততক্ষণ সামান্য কিছু মাইনে পান, ব্যাস! তাঁদের না থাকে কাজের নির্দিষ্ট ঘণ্টা, না সাপ্তাহিক ছুটি, না পর্যাপ্ত বেতন, তাঁদের কোন বিমা, পেনশনের ব্যবস্থাও থাকে না। তাঁদের কাজের জায়গায় ন্যুনতম সুরক্ষা, স্বাস্থ্য, পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা পর্যন্ত থাকে না।
– কিন্তু সেটা তো বেআইনি।
– নিয়ম থাকলেই সবসময় সেটা অক্ষরে অক্ষরে মানা হয় না টিনটিন। ধরো, এই ক্ষতিপূরণের ব্যাপারটা; যারা এইসব ছোট কারখানায় কাজ করেন, তাঁরা কোন পে-স্লিপ পান না, অতএব যদি তাঁরা ক্ষতিপূরণের মামলা করেন, কোম্পানি খুব সহজেই প্রমাণ করে দেবে, তাঁরা আসলে ওখানে কাজই করতেন না।
– সেকি!
– আবার ধরো, ওভারটাইম কাজ করালে, শ্রমিককে তার সাধারণ বেতনের দ্বিগুণ দেওয়া উচিত, কিন্তু দ্বিগুণ তো দুরের কথা, ছোট কারখানাগুলোয় একটি পয়সাও বেশি দেওয়া হয় না।
– কি করে?
– ব্যাপারটা কি হয়, শ্রমিকদের একটা টার্গেট দেওয়া হয়, যে এই পরিমাণ কাজ একদিনে করতেই হবে, এবার সেই টার্গেট পূরণ না করতে পারলে যে ওভারটাইম করতে হয়, তার জন্য কোন পয়সা দেওয়া হয় না। দেখেছ, ওই যে আঙ্কেল দুজন চৌকো-চৌকো কাঠগুলোর উপর কেটে কেটে ডিজাইন করছেন, এতক্ষণে একবারও থামেননি, মাথাও তোলেননি। এরকম প্রায় চল্লিশটা কাঠ আজকের মধ্যে করতে হবে। ইচ্ছা করেই এমন টার্গেট দেওয়া হয় যাতে ওভারটাইম না করলে শেষ হবে না।
– কতক্ষণ কাজ করানো হয়?
– সাধারণত, এসব কারখানায় কাজ শুরু হয়, ৮টা-সাড়ে ৮টায়, শেষ হয় পাঁচটা নাগাদ, ওভারটাইম চলে রাত্রি ৮টা, শিপিংয়ের সময় রাত্রি দশটা পর্যন্ত।
– এরা কিছু বলে না, এতক্ষণ কাজ করতে হয়?
– আসলে, এঁরা বেশিরভাগই লেখাপড়ার সুযোগ পাননি, তাই সমস্ত তাঁদের জন্য যে সব আইন আছে, যে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়, তাঁরা জানতেই পারেন না বেশিরভাগ সময়। আর, এদের যে পরিমাণ বেতন দেওয়া হয়, তাতে অনেকেরই সব জেনেও বাধ্য হয়ে ওভারটাইম করতে হয়, না হলে সংসার খরচ ওঠে না।
– সো স্যাড, আমার খুব খারাপ লাগছে, চলো আমরা অন্য জায়গায় যাই।
– চলো।

এরপর আসা হল, ফুটবলের বাড়িতে, ছোট্ট একটা ঘর দিনের বেলাতেও ডুম জ্বলছে, দুজন মহিলা বসে বসে বল সেলাই করছেন। একটা বাচ্ছা ছেলে পাশে বসে প্যানেলে আঠা লাগাচ্ছে, আর ব্লাডারের উপর আটকাচ্ছে, একদম টিনটিনেরই বয়সী।
-এটা কোথায়?
-এটা পাকিস্তানের শিয়ালকোট শিল্পাঞ্চলের কাছে একটা গ্রাম। এখানে প্রচুর লোক এই কাজ করেন, কেউ কেউ বল তৈরির কারখানায় কাজ করেন, সেখান থেকে বাড়িতে নিয়ে আসেন জিনিসপত্র, বাড়িতে সবাই মিলে করেন। কেউ কেউ চুক্তির ভিত্তিতে বাড়িতে বসে কাজ করেন, সেখানে বেশিরভাগই মহিলা।
-এরা কেউই টেররিস্ট নয়?
-না। পাকিস্তানি মাত্রই টেররিস্ট নয় টিনটিন, পাকিস্তানও তোমার ভারতের মত একটা দেশ, সেখানে প্রচুর সাধারণ মানুষ বাস করেন। কি করে পরের দিনের খাবার জুটবে, তাই ভাবতে তাঁদের সারাদিন চলে যায়, এসব নিয়ে ভাবার বিশেষ সময় পান না। কিছু লোক নিজেদের স্বার্থে সাধারণ লোককে ভুল বুঝিয়ে ঝামেলা পাকায়, সেরকম লোক সবজায়গাতেই আছে। পাকিস্তানেও সাধারণ লোকের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয় টেররিস্টদের জন্য। পাকিস্তান দেশটার অবস্থা এইজন্যই এত খারাপ। দেখোই না এদের অবস্থাটা…
– আচ্ছা, এরা দিনে কতগুলো বল তৈরি করে?
-এই যে আন্টিগুলো কাজ করছেন, এনারা দিনে তিনটে করে বল তৈরি করেন, বল প্রতি আশি থেকে একশ টাকা পান। সেগুলো পেশাদারি বল। সাধারণ বাজারি বল যারা তৈরি করেন তারা পঞ্চাশ থেকে ষাট টাকা পান।
-কিন্তু এই বলগুলো তো আডিডাসের, একেকটা বল ৮-১০ হাজার টাকা দাম!
-আসলে, বিভিন্ন সেন্টার এই ধরনের বল তৈরির প্যানেল, রঙ, ব্লাডার, সুতো নিয়ে আসে, তারা নিজেদের কারখানায় লোক দিয়ে কাজ করায়, আবার বাইরে এদের দিয়ে কাজ করায় অনেক কম মজুরিতে। বিভিন্ন হাত ঘুরে এদের কাছে আসে জিনিসপত্র, আবার এদের কাছ থেকে তৈরি বল অনেক হাত ঘুরে ঘুরে পৌঁছয় আডিডাসের কাছে, সেকারনেই এদের হাতে বলের দামের চেয়ে এত কম টাকা আসে। সাধারণত, কারখানায় যারা কাজ করে, তাদের সারামাসের মজুরি, একটা বলের দামের চেয়ে কম হয়।
-কি অদ্ভুত! আচ্ছা, ওই যে ছেলেটা কাজ করছে, ওরও কি স্কুল নেই?
-না। পাকিস্তানে ৬৫ লক্ষ শিশু ৯ বছর বয়সের আগে প্রাইমারি স্কুল থেকেই পড়া ছেড়ে দেয়। প্রতি পাঁচটি গ্রাম পিছু একটি গ্রামে কোন স্কুল নেই। বুঝতেই পারছ…
-কি অবস্থা! এরা এখানে কাজ করে? কিন্তু শিশুশ্রম তো বেআইনি।
-হ্যাঁ, বেআইনি তো বটেই। ১৯৯৬ এ ইউরোপিয়ান কাপ চলাকালীন এদের নিয়ে অনেক খবর হয়েছিল, তখন এরা কারখানাতেই কাজ করত। একবছর পরে একটা চুক্তি হয়েছিল এখানে শিশুশ্রম বন্ধের জন্য।
-তাহলে?
-কিন্তু তাতে আসল সমস্যার সমাধান হয়নি। ওই যে ছেলেটা দেখলে, ওর বাবা, মা দুজনেই বল বানানোর কাজে যুক্ত। তাতে যা রোজগার হয়, তিনজনের চলে না। তাছাড়া, স্কুলেরও অবস্থা তো শুনলে। চুক্তিতে অনেক স্কুল তৈরির কথা বলা হলেও, সেগুলো বেশিরভাগই খাতায়-কলমে হয়েছে। এই কাজ না করলেও, ওকে অন্য কোথাও কাজ করতেই হত, ইঁটভাঁটায়, বা অন্য কোন কারখানায়।
-সত্যিই খুব খারাপ ব্যাপার, ওর কোনদিনই স্কুল যাওয়া হবে না।
-ও যে বল বানাচ্ছে এতদিন ধরে, সেটার একটাও কোনদিন ও হাতে পাবে না।
-কিন্তু, এরকম কেন হবে? যারা কাজ করবে, তারা সবসময় কষ্ট করে কাজই করে যাবে, সব কিছু তৈরি করবে, কিন্তু কিছুই পাবে না, কেন?
-এটা বড় কঠিন প্রশ্ন টিনটিন, প্রশ্নটা অনেক পুরোনোও। যেকোনো প্রাণীকে বেঁচে থাকার জন্য খাবার, আশ্রয় জোগাড় করতে হয়, মানুষও করে। তফাৎ এই যে, মানুষ হাতিয়ার বা যন্ত্র ব্যবহার করতে শিখেছে, মানুষ প্রয়োজনীয় জিনিস তৈরি বা উৎপাদন করতে পারে, অন্যরা কিছুই বানাতে পারে না, শুধু খুঁজে খুঁজে জোগাড় করে। এবার এই হাতিয়ারগুলো নিয়েই হল আসল মজা, আস্তে আস্তে মানুষ কাজ করতে করতে অনেক নতুন কিছু শিখতে থাকল,আর হাতিয়ারগুলোও আস্তে আস্তে উন্নত হতে থাকল। যত ভালো যন্ত্র, তত বেশি জিনিস তৈরি করা যায়। এবার একদল লোক, যারা এই যন্ত্রগুলোর ব্যবহার জানত, তারা সবকিছুর মালিক হয়ে বসল। তারা করল কি, নিজেরা আর কাজ করল না, অন্যদেরকে এই হাতিয়ারগুলো দিয়ে তাদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে থাকল। এমনিকরে দাসব্যবস্থা এল, সামন্তপ্রথা এল, তুমি হিস্ট্রিতে তো পড়েছ তখনকার কথা, প্রভুরা বা রাজারা সমস্ত কিছুর মালিক ছিল। আর যন্ত্র ছাড়া কোন কিছু বানানো সম্ভব নয়, তাই সবাই তাদের অধীনেই কাজ করত। যা কিছু তৈরি হত, প্রভু বা রাজারাই সবকিছুর মালিক হয়ে বসত। দাসব্যবস্থায় তো প্রভুরা দাসদেরও মালিক ছিল। তৈরি হওয়া জিনিস থেকে যা আয় হত, তাই দিয়ে আরও যন্ত্রপাতি বানানো হত, কিন্তু সবকিছুর মালিক হিসাবে তারাই সেগুলো দখল করে নিত। এভাবে যারা কাজ করত, তাদের হাতে কিছুই থাকত না।
– এখন তো রাজারা আর নেই, দাসেরাও নেই।
– আপাতভাবে নেই, কিন্তু তাতে কিচ্ছু বদলায়নি টিনটিন। আস্তে আস্তে যন্ত্রপাতি উন্নত হতে হতে এখন এমন জায়গায় এসেছে, যাতে বড় কারখানায় অনেক যন্ত্র দিয়ে একসঙ্গে কাজ না করলে প্রয়োজনমত জিনিসপত্র বানানো সম্ভব নয়। এখন সেইসব কারখানার মালিকেরা রাজার জায়গা নিয়েছে, আর কারখানায় যারা কাজ করে তারা দাস হয়ে গেছে। খাটুনি করার জন্য গায়ের জোর তাদের হাতে কিছুই নেই, সেজন্য তারা কারখানাগুলোয় কাজ করতে বাধ্য, সেখানে তারা যে পরিশ্রম করে, তার বদলে তাদের প্রয়োজনীয় খাবার, জামাকাপড় পায়।
– কিন্তু এতই কি কম জিনিস তৈরি হয় যে এরকম অবস্থা হবে?
– মোটেই না, প্রচুর পরিমাণে জিনিস তৈরি হয় টিনটিন, এখনকার কারখানায় বিশাল বিশাল যন্ত্রপাতির সাহায্যে যে পরিমাণ জিনিস তৈরি হয়, কয়েকবছর আগে লোকে ভাবতেই পারত না।
– তাহলে, সেসব কোথায় যায়?
– মালিকদের কাছে। তারা শ্রমিকদের তৈরি জিনিস শ্রমিকদেরই বেচে, অনেক চড়া দামে, আর তাতে যে পরিমাণ টাকা লাভ হয়, সেটা আবার ব্যাবসায় খাটায়। শ্রমিকদের ভাগে তার ছিটেফোঁটাটুকুই জোটে, যেটুকু হলে কোনরকমে খেয়ে-পরে বাঁচা যায়, ভালোভাবে থাকা যায় না।
– এটা তো অন্যায়।
– হ্যাঁ, অন্যায় তো অবশ্যই, কিন্তু বহুকাল ধরে এরকম চলতে চলতে এখন এমন অবস্থায় পৌঁছে গেছে যে, প্রায় সব কারখানা, মালপত্র, জায়গা-জমি, সমস্তই মালিকদের হাতে চলে গেছে আর, শ্রমিকরা তীব্র অভাবের জ্বালায়, যেখানে যেটুকু পাচ্ছে, সেটার জন্যই প্রাণপণে কাজ করছে। এখন কারও একার পক্ষে এ জিনিসটা বন্ধ করা সম্ভব নয়, চেষ্টা করতে গেলে সে ই কোণঠাসা হয়ে পড়বে। এখন যদি কিছু করতে হয়, গোটা মালিকদের দলের বিরুদ্ধে গোটা শ্রমিকদের দলকে একসঙ্গে লড়াই করতে হবে।
– কিন্তু, মানুষ এরকম কেন করে? আর এরকম কতদিন চলবে, কিছু কি করা যায় না?
– অনেকদিন ধরেই এরকম হয়ে আসছে, কিন্তু কেন হয় কেউ ঠিকঠাক জানে না। অনেকে অনেক কিছু বলে গেছেন এ নিয়ে, তুমি বড় হলে সেসব পড়বে, জানবে, তখন তুমি ভেবেচিন্তে কারণগুলো বের কোর তোমার মত করে।
– আমি আর কোথাও যাব না, আমার খুব মনখারাপ করছে। সব জায়গাতেই খালি কষ্ট আর দুঃখ।
– আচ্ছা আর কোথাও যাব না, কিন্তু আমি ভেবেছিলাম তোমায় একবার পাপার কাছ থেকে ঘুরিয়ে আনব।
– হ্যাঁ হ্যাঁ, পাপার কাছে যাব। পাপার অফিস দেখব।
– আচ্ছা চলো।

বহুজাতিক সংস্থার অফিস, ঝাঁ চকচকে আসবাব, নিঃশব্দ, শীততাপনিয়ন্ত্রিত। কিউবিকলে সবাই বসে কাজ করছে, খালি কিবোর্ডের শব্দ হচ্ছে, কেউ মাথা তুলছে না। কোন কথাবার্তা, হাসির শব্দ নেই, গোটা জায়গাটার আবহাওয়াটাই কেমন গম্ভীর।
– বাব্বাহ্‌, কি বড় অফিস! কি ঠাণ্ডা! কি সুন্দর সাজানো, কি পরিস্কার। ওই তো পাপা! সেই কম্পিউটারের মধ্যে মুখ গুঁজে, মা কত বকে, তাও দেখো সেই ঝুঁকে, ঘাড় কুঁজো করে…
আচ্ছা, এত সুন্দর অফিস কিন্তু কেউ কথা বলছে না কেন? কেউ হাসছে না, গল্প করছে না, কারও দিকে তাকাচ্ছে না, সবাই যেন কিরকম গম্ভীর হয়ে আছে, কেন? এদের কি কোন এক্সাম চলছে?
– টিনটিন, তোমার পাপা কটায় অফিস যায়?
– আটটায়, সকালে।
– ফেরে?
– রাত্তির হয়ে গেলে, আমি তখন শুয়ে পড়ি।
– এতক্ষণ ধরে সবাই মিলে কাজ করে, তাও কত কত কাজ, শেষই হয় না, কি করে গল্প করবে, হাসবে, সময় কোথায়? এই অফিসটা দেখতে সুন্দর, এসি আছে, তোমার পাপারাও ভালো ভালো জামাকাপড় পড়ে আসেন, কিন্তু এখানে পরিস্থিতিটা কিচ্ছু আলাদা নয় টিনটিন। এখানেও বিশাল বিশাল টার্গেট আছে, জোর করে ওভারটাইম করানো আছে, চাকরি চলে যাওয়ার দুশ্চিন্তা আছে। অন্যায় এখানেও হয়, কিন্তু এত সাজিয়ে গুছিয়ে পরিপাটিভাবে, চট করে বোঝা যাবে না।
– কিন্তু পাপারাও কি আইন বা নিয়মগুলো জানে না?
– জানেন, কিন্তু ওই যে তোমায় বললাম একা একা হঠাৎ করে কেউ কিছুই করতে পারবে না।
– সবাই মিলে করে না কেন?
– সেটা তুমি পরে কোন একদিন পাপাকেই জিজ্ঞেস কোর, কেমন?
– এখানেও সবাই লং টাইম কাজ করে, কারও ছুটি নেই?
– কারও ছুটি নেই, তোমার পাপা আজ তোমায় নিয়ে ডগি কিনতে যাবে বলেছিল, কিন্তু সেই এখানে আসতে হল। সবাই এরকম ভাবেই সবাইকে ফেলে এসেছে বাড়িতে। কারোরই ইচ্ছা ছিল না, তবুও আসতে হয়েছে।
– পাপার মুখটা কি স্যাড দেখাচ্ছে, তবু একটুও থামছে না, খালি টাইপ করে যাচ্ছে।
– তোমাকে তো বলেইছিলাম টিনটিন, কেউ হ্যাপি নেই।
– আমি বাড়ি যাব, আমার ভালো লাগছে না।
বাড়িতে এসে সবাই মিলে বসল টিনটিনের ঘরে, সবারই মন খারাপ, সবাই বাড়িতে গিয়ে দেখে এসেছে তাদের চেনা লোকেরা কেউ ভালো নেই। টিনটিনই প্রথম কথা বলল,
“আচ্ছা সবাইকে এত কাজ করতে হয়, এতক্ষণ কাজ করতে হয়?”
-“হ্যাঁ, যারা কাজ করে, তাদের প্রায় সবাইকেই এরকমভাবেই কাজ করতে হয়।” ফুটবল বলল।
– কেন?
– কেউ কিছু বলে না? সবারই নিশ্চয়ই প্রবলেম হয়?
এতক্ষণে কাবার্ড কথা বলল,
– টিনটিন, তুমি হিস্ট্রিতে মে দিবসের কথা পড়নি? তুমি কি জান না, আজ তোমাদের স্কুল ছুটি কেন?
– না, আমাদের হিস্ট্রিতে ছিল, কিন্তু ওই চ্যাপ্টারটা বাদ দিয়েও সিলেবাস অনুযায়ী ফুল মার্ক্স অ্যাটেন্ড করা যেত, তাই শেফালি মিস ওটা আর কভার করেননি।
– আজকের দিনটি হল, আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস, ১৮৮৬ সালে, দিনে আট ঘণ্টার বেশি কাজ নয়, এই দাবিতে পয়লা মে থেকে শিকাগোয় শ্রমিকরা মিছিল করেছিল। একদিন মিছিলে কেউ বোমা ছুঁড়লে, অনেকজন শ্রমিক এবং পুলিশ অফিসার মারা যান। এরপর মিছিলের উপর গুলি চালানো হয়েছিল,কিছু শ্রমিক নেতাকে গ্রেফতার করে ফাঁসি দেওয়া হয় পুলিশ অফিসার হত্যার অভিযোগে। তার পরে অনেক আন্দোলন হয়, সেই বিচারটিকে অন্যায় বলে উল্লেখ করে শ্রমিকদের নির্দোষ বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। শেষে শ্রমিকদের আট ঘণ্টা কাজের দাবি মেনে নেওয়া হয়েছিল। পরে পয়লা মে, আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসাবে ঘোষিত হয়।
– কিন্তু এখনও তো সবাই আট ঘণ্টার বেশি কাজ করে?
– করে, করতে বাধ্য হয়, কখনও তার পারিশ্রমিক পায়, কখনও পায় না।
– ভেরি স্যাড। আমার খুব খারাপ লাগছে। আমি কি কিছু করতে পারি না? ইন ফ্যাক্ট, পাপাও তো একই প্রবলেম ফেস করছে।
– টিনটিন, তুমি আজকে যা দেখলে তাতে তুমি অনেক কিছু জানতে পারলে, বড় হলে আরও পড়বে, আরও জানবে, নিজেই ঠিক করবে কি করবে। কিন্তু, যারা কাজ করেন, মানে যারা ‘শ্রমিক’, তাঁদের কথা সবসময় মনে রাখবে, তাঁরাই আমাদের সবকিছু বানিয়ে দেন, আমরা যাতে আরামে থাকি,তার সব ব্যবস্থা করে দেন, কিন্তু তাঁদের জন্য কিছু করার বেশি কেউ নেই।

হঠাৎ করে মার গলার আওয়াজ পাওয়া যায়, সবাই তাড়াতাড়ি কাবার্ডে ঢুকে যায়। টিনটিন আবার সোফায় এসে শুয়ে পড়ে। মা এসে টিনটিনের মাথার চুল ঘেঁটে দেন, “এতক্ষণ ধরে সোফায় শুয়ে শুয়ে ঘুমোচ্ছিস, খেলিও তো না কিছু। দেখ পাপা কত তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে এসেছে! এবার সবাই মিলে ডগি আনতে যাব।”
টিনটিন লাফিয়ে ওঠে, দৌড়ে যায় দরজায়, দেখে পাপা জুতো খুলছে। পাপা বলে, “দেখ তোর জন্য আজকে তাড়াতাড়ি করে পালিয়ে এলাম, চ দেখি, আজই যদি হয়, দোকানটায় ঘুরে আসব, একটু বসে নিই, তুই তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে।”
– “আজকে ছেড়ে দাও পাপা, সানডে যাব, তুমি এত কাজ করে এলে, তুমি খুব ক্লান্ত।”
কোনও উত্তর না পেয়ে পাপার দিকে তাকিয়ে টিনটিন দেখে পাপা একটা জুতো খুলে চুপ করে বসে কিরকম একটা মুখ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।কিছুক্ষণ পরে একটু ধরা গলায় খুব আস্তে আস্তে বলল- “থ্যাঙ্ক ইয়ু টিনটিন, আজকে আমি সত্যিই ক্লান্ত, সানডে সিওর যাব, আরও একটা জায়গায় নিয়ে যাব তোমাকে।” বলেই মুখ নামিয়ে জুতো খুলতে আরম্ভ করল।
টিনটিন ঘরে এসে দেখল কাবার্ড মিটিমিটি হাসছে, সেও একটু হেসে দিল। আজকের দিনটা বেশ অন্যরকম হল, সবজায়গায় ঘুরে ঘুরে দেখে মনটা একটু খারাপ গেলেও অদ্ভুতভাবে কিছু নতুন বন্ধু পেয়ে আনন্দও হচ্ছে কিছুটা। বুকশেলফে আগের ক্লাসের হিস্ট্রি বইটা খুঁজতে খুঁজতে টিনটিন ভাবছিল, এবার থেকে কারও সঙ্গে কোন কম্পিটিশন নয়, ঝগড়া নয়, সকলের বন্ধু হতে হবে, একা একা কিছু করা যায় না। সবাইকেই কাজ করতে হবে একদিন, তখন নিশ্চয়ই কেউ এরকম অবস্থা চাইবে না। সেজন্যই, সবাই যদি ঠিকমত বুঝতে পারে, সবাই মিলে প্রবলেমটা সলভ করে ফেলা যাবে।

Leave a comment